সময় জার্নাল প্রতিবেদক:
সহস্র বছরের শোষণ-বঞ্চণায় বিশ্বকবির সোনার বাংলা মূলতঃ শোষণের বাংলা হয়ে ওঠে। ব্রিটিশদের শোষণে শাসনে বাংলাদেশ যেন এক মহা-শ্বশানে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশরা বিদায় নিলেও পশ্চিম পাকিস্তানীরা এই দেশকে নব্য উপনিবেশে পরিণত করে নতুন মাত্রায় শোষণ করে।
মওলানা ভাসানী পাকিস্তানী শোষকদের বিদায়ী সালাম জানান। তাঁর মানসপুত্র বঙ্গবন্ধু স্বাধীকার আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরেও টিক্কা খানের পোড়ামাটির নীতিতে বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখতে কাপুরুষের মতো গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র সংগ্রামের পর ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের সাগর পেরিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের।
নব্য স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলা করে গড়ে তোলার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, তা তিনি শুরু করলেও বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরেই এই জাতীয়তাবাদী মহান নেতাকে দেশি-বিদেশি কুচক্রি মহলের প্ররোচনায় স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ফলে স্বাধীনতার ফসল আজও সব মানুষের ঘরে পৌঁছেনি। আজও গৃহহীন, কর্মহীন কোটি মানুষ দরিদ্র, আজও অভাব জনগণের নিত্য সঙ্গী। বঙ্গবন্ধু কন্যা এখন দেশের কর্ণধার তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে চাইলেও তা কি সম্ভব ? সত্যি কি সম্ভব বাংলাদেশকে সোনার বাংলা রূপে গড়ে তোলা ?
এই জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতেই অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক পারভেজ যিনি নিজেকে অর্থনীতির ছাত্র বলতেই ভালোবাসেন- তিনি অত্যন্ত সহজ সরলভাবে সোনার বাংলা তথা সুষম সমাজ গড়ার পথ বাৎলে দিয়েছেন।
সমাজবিজ্ঞনী ও অর্থনীতিবিদদের কাজ রাষ্ট্রকে সরকারকে উন্নতির সোপান দেখানো । এই পথ দেখানো কঠিন কাজটা হাতে নিয়েছেন অধ্যাপক পারভেজ। সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির জটিল বিষয়কে তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন তাঁর "সুষম সমাজ বিনির্মাণ' নামক গ্রন্থে। এজন্য পাঠককে সমাজবিজ্ঞান বা অর্থনীতির ছাত্র হবার প্রয়োজন পরেনা।
সুষম সমাজ বিনির্মাণ” নামক গবেষণামূলক গ্রন্থে তিনি দেশের সমন্বিত উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্রমুক্ত, অবক্ষয়মুক্ত, কর্মমুখর সমৃদ্ধ এক সমাজ কাঠামোর চিত্র উপস্থাপন করেছেন যে সমাজে দারিদ্র, বেকারত্ব ও অবক্ষয় ঠাঁই পাবে না। তাঁর গ্রন্থের মুখবন্ধ পাঠে জানা যায় যে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গ স্বচ্ছ, তাই কথার মার-প্যাচে না গিয়ে খুব সাধাসিধাভাবে যে সমাজব্যবস্থার ফর্মূলা তিনি দিয়েছেন, তা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিশারী হতে পারে। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের দ্বন্ধে না জড়িয়ে কি ভাবে একটি বিকল্প সমাজ ব্যবস্থা গড়া যায়, তারই বয়ান এই "সুষম সমাজ বিনির্মাণ' নামক গবেষণামূলক গ্রন্থ।
তিনি তাঁর উপলব্ধিতে বয়ান করেছেন, যে রাজনৈতিক স্বাধীনতার অর্ধশতক পার হলেও আজও জন মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। আজও দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ শোষণ-বঞ্চনায় জর্জর। দেশের কোটি কোটি মানুষ চরম দারিদ্রতায় জীবন যাপন করে, এই দারিদ্র দূর করা না গেলে সত্যিকারের কোন টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। অথচ তিনি ধনী এক বণিক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেও মাটি ও মানুষের এতোটা কাছাকাছি এলেন কি করে তা বিস্ময় সৃষ্টি করে। অবাক পৃথিবী” পরিচ্ছদে তিনি দেখিয়েছেন কি ভাবে শোষণ শুধু রাষ্ট্রের ভিতরেই নয়, বিশ্বজুড়ে তা বিদ্যমান বিশ্বের ৭৫% সম্পদ দখল করে আছে মাত্র ১৫টি রাষ্ট্র ! শামন্ত যুগেও যেমন, বর্তমান পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাতেও তেমন। সম্পদ ক্ষমতাবান ও শক্তিশালীদের হাতে কুক্ষিগত হয়। অধ্যাপক পারভেজ-এর দিক-দর্শন এখানেই, তিনি বলেছেন, কেন্দ্রিভূত অর্থ-সম্পদকে অলসভাবে না রেখে তা বিকেন্দ্রিভূত করতে হবে। সমাজের প্রায়োরিটি অংশে অর্থ সঞ্চালিত করা গেলে সমাজ গতিশীল হবে এবং মানুষের দারিদ্র মুক্তি সম্ভব হবে। তিনি উদাহরন দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, বৈষম্য থাকলে টেকসই উন্নয়ন কোন মতেই সম্ভব হবেনা । "স্ফুলিঙের উন্নয়ন বনাম টেকসেই উন্নয়ন" পরিচ্ছদে তিনি উদাহরনসহ দেখিয়েছেন অর্থ থাকলেই হবেনা বরং অর্থের যথার্থ ব্যবহারও নিশ্চিত করতে না পারলে অর্থনৈতিক সফলতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা আসবেনা। অধ্যাপক পারভেজ-এর মতে সমাজকে সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল করতে হলে বেকারত্ব দূর করতে হবে, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধ স্থিতিশীল ও অবক্ষয়মুক্ত সমাজ তথা "সুষম সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব হবে।
অধ্যাপক পারভেজ "সুষম সমাজ বিনির্মাণ" এ সমাজ ও অর্থনীতির নতুন এক দর্শন উপস্থাপন করেছেন। তিনি পুঁজিবাদের শোষণ ও সমাজতন্ত্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণের বাহিরে গিয়ে জীবনমুখি এক অর্থ-ব্যবস্থার কথা বলছেন। আর তা হচ্ছে, রাষ্ট্রের হাতে ও ব্যাংক-বীমার হাতে পুঞ্জিভূত অর্থকে বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে সাধারণ সব মানুষের মাঝে প্রবাহিত করা। সমাজের সর্বস্তরে অর্থপ্রবাহ নিশ্চিত হলে সার্বিক উন্নয়ন আপনা-আপনিই সম্ভব হবে এবং সামাজিক অবক্ষয় দূর হয়ে যে সুষম সমাজ তৈরী হবে, তাকেই সোনার বাংলা বলা যেতে পারে।
অর্থনীতিবিদের দেখা যায় সব সময় সরকারের মুখোমুখী হতে। এক্ষেত্রে অধ্যাপক পারভেজ বিকল্প পথে হেঁটেছেন।
অর্থনীতিবিদরা উন্নয়নের পথ বাৎলে দেন। সরকার তা গ্রহণ করতেও পারে, আবার নাও পারে। তবে গ্রহণযোগ্য ফর্মূলা বাস্তবায়ন করতে পারে একমাত্র সরকারই। তাই অধ্যাপক পারভেজ হয়তো ঐ পথে হাঁটছেন।
তিনি নীতি নির্ধারক ও বাস্তবায়কদের মনের অন্দর-মহলে তার সুষম সমাজ বিনির্মাণের চেতনাকে 'পুশ' করতে চান ।কারণ তার দিক-দর্শন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার গড়ার চেতনার সমার্থক। রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা থাকলে তাঁর লক্ষ সহজেই সাফল্যমন্ডিত করা সম্ভব হবে।
“সুষম সমাজ বিনির্মণ" গ্রন্থে তিনি সুষম সমাজের ধারণা দিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়নে ২৭ দফার প্রন্থাবনা দিয়েছেন।
তাতে তিনি প্রথমেই দেখেছেন বেকারত্ব দুরীকরণের কথা । বেকারত্ব যে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে বড় অন্তরায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর বেকারত্ব দূর হলে ঐ ব্যক্তি ও তার পরিবার মৌলিকচাহিদার পুরণের তাড়ণা থেকে মুক্তি পায়।
তিনি ২য় দফায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন তা হচ্ছে, মাথাপিছু গড় আয় নিয়ে আমরা বাগাড়ম্বর করে থাকি। কিন্তু তিনি বলেছেন, যদি ঐ পরিমান অর্থ প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়, তবে, সমাজ থেকে দারিদ্র নির্বাসনে যাবে।
এমআই